শোভন চেয়ারে এসির কনকনে হাওয়া, বাইরে সবুজ প্রকৃতি, নিরবিচ্ছিন্ন যাত্রা। ট্রেন ছুটছে আপন তাল। শহর পেরিয়ে গ্রাম, গ্রাম ডিঙিয়ে ফের শহর। মধ্যবিত্তের জন্য সবুজ বেঞ্চির মতোন সাধারণ বগি, জানালা খোলা যায়। তবু, সৌন্দর্য্য সেখানেও ভর করে। ঝকঝক শব্দে এগিয়ে আসছে গন্তব্য, সুখের ভ্রমণে ট্রেনের বিকল্প ট্রেনই। মেট্রোরেল, পাতাল রেলের গল্পটা আমাদের রোজকার। তবে এমন কিছু ট্রেন আছে বিশ্বজোড়া যেসব সাধারণের জন্যে প্রযোজ্য নয়। বিলাসিতার চূড়ান্ত আয়োজনের পসরা সাজিয়ে বসা সেসব ট্রেনের ভেতর বাহিরের গল্পটা যে কারো চোখকেই চড়কগাছে তুলে দিবে নিমেষেই। গাঁটের পয়সা খরচ করে ভ্রমণপিয়াসী শৌখিন মানুষেরা মনে করিয়ে দেয় পুরনো প্রবাদ- ‘শখের তোলা আশি টাকা’! শৌখিন লোকের শৌখিন ভ্রমণের সঙ্গী তেমন কিছু ট্রেন নিয়েই চলুন জানা যাক। আমাদের চলার পথে ঝকঝক শব্দ হবে না, মুখটা হা হয়ে থাকলে শব্দ আসবেই বা কোত্থেকে!
দি ওরিয়েন্ট এক্সপ্রেস
১৮৮২ সালের অক্টোবরের দশম দিবসের এক সন্ধ্যায়, বেলজিয়ামের জর্জ ন্যাগমেকার্স নামক ব্যাংকারপুত্র কজন বন্ধুদের আমন্ত্রণ করেন তার বিলাসবহুল ট্রেনটার প্রথম ভ্রমণের যাত্রাসঙ্গী হতে। সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টায় শুরু হয় সেই যাত্রা, আজো চলছে। বিশ্বের অন্যতম বিলাসী ট্রেনই নয়, প্রাচীন ও ঐতিহ্যবাহী ট্রেনটি ভেনিস সিম্পলন এক্সপ্রেস নামে। এই ট্রেনে রয়েছে নানান শ্রেণীভাগ। কোনটা সরকারি আমলাদের, কোনটায় কূটনীতিক, বাকীটা অভিজাতদের জন্য। রয়্যাল ট্রাভেলার্স সেবার আওতায় ট্রেনে রয়েছে এলাহি ব্যাপার স্যাপার। ট্রেনের বগি সর্বোচ্চ ২২টি হলেও বেশিভাগ সময়েই এতগুলো বগি নিয়ে যাত্রায় বের হয় না এটি। গোটা ইউরোপ থেকে যাত্রী তুলতে পারা সিম্পলন ছয়টি দেশ ও দশটি ভিন্ন ভিন্ন রেলপথে প্রবেশের অধিকার রাখে। সিম্পলনের যাত্রীদের খাবার পরিবেশন করা হয় রূপা এবং চিনামাটির বাসনে।
ডাইনিং সাজানো হয় ধবধবে দুধ সাদা লিলেন কাপড় দিয়ে। যাত্রীদের জন্য রয়েছে ড্রেসকোড। খেতে হলে পুরুষদের পড়তে হবে কালো স্যুট, মেয়েদের গাউন। ওরিয়েন্ট এক্সপ্রেস নিয়ে রচিত হয়েছে বহু সাহিত্য, যার কোন কোনটা ঠাঁই পেয়েছে সিনেমার পর্দায়। ওরিয়েন্ট এক্সপ্রেস, ইস্তাম্বুল এক্সপ্রেস, ফ্রম রাশিয়া উইথ লাভ, ট্রাভেলস উইথ মাই আন্ট এগুলো সবই বই থেকে পরবর্তীতে সিনেমায় আবর্তিত হয়। এছাড়াও অসংখ্য গান, ডকুমেন্টারি, টিভি সিরিজ প্রমাণ করে ওরিয়েন্ট এক্সপ্রেসের মুন্সীয়ানাকে।
ইস্টার্ন এক্সপ্রেসওয়ে
১৯৩৬ সালে তুর্কি রেলওয়ের এই ট্রেনটির সেবাদান শুরু হয়। ভ্রমণকালে আমাদের রোমান্টিসিজম বেড়ে যায় বহুগুণ। প্রিয়তম প্রিয়তমার সঙ্গে একান্ত ভ্রমণে সম্ভাব্য সবই করেন একটি সুন্দর যাত্রা উপহার দিতে। জানলা দিয়ে সবুজের সমারোহ, দিগন্ত বিস্তৃত মাঠ যেখানে আকাশ ছুঁয়েছে মাটিকে, নদীর কলকল স্বচ্ছজল এসব দেখে মুগ্ধতার পরশ স্পর্শ করে। ভাবুন তো এদের সাথে যদি যুক্ত হয় পাহাড়, জঙ্গল, ফসলের মাঠ আর হঠাৎ করে দীর্ঘ অন্ধকার এক টানেল! প্রেয়সীর হাত ধরে বসে আছেন। ভয় ও ভালোলাগার মিশেলে অদ্ভুত অনুভূতি! ইস্টার্ন এক্সপ্রেস এমন সব রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতাই উপহার দিবে। আর্মেনিয়া সীমান্তবর্তী অঞ্চল হয়ে আনাতোলিয়া অঞ্চল ঘুরে গন্তব্যে পৌঁছানো ট্রেনটির দারুণ গতি একে একদিনে ১৩৫০ এরও বেশি কিলোমিটার পথ অতিক্রম করাতে পারে। বিলাসী এই ভ্রমনে সুখের মূহুর্তকে বাড়িয়ে দিতে রয়েছে সুস্বাদু সব খাবার, পানীয় এবং মনোরম মনোরঞ্জনের ব্যবস্থা।
মহারাজা
২০১০ সালে পৃথিবীর চতুর্থ বিলাসবহুল ট্রেন নির্বাচিত হওয়া মহারাজা এক্সপ্রেসে চড়তে পকেট থাকা লাগবে অসম্ভব ভারী! উপমহাদেশের সেরা ট্রেনটির সাধারণ কামড়া বা স্যুটের দিনপ্রতি মাথাপিছু খরচ মাত্র ৮০০ ইউএস ডলার। সর্বোচ্চ ২৫০০ ডলারের স্যুটও রয়েছে তাতে। বিলাসীর বিলাসিতার পয়সা উসুল হোক বা না হোক, মন পরিতৃপ্তি পাবে সেই বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। ২৩ কামড়ার ট্রেনে একসঙ্গে ভ্রমণ করতে পারবে ৮৮ জন যাত্রী। যাদের প্রত্যেকের জন্য রয়েছে ভোগবিলাসে নিমগ্ন হবার চূড়ান্ত ব্যবস্থা! ডাইনিং, বার, ভিআইপি লাউঞ্জ, জেনারেটর এসব তো কমন ব্যপার। প্রতি স্যুটে রয়েছে রুম টেম্পারেচার সিস্টেম, এলসিডি টিভি, টেলিফোন, হাইস্পিড ইন্টারনেট, ডিভিডি প্লেয়ারসহ চিত্তাকর্ষক আরো অসংখ্য জিনিস। মহারাজায় ৬ রাত ৭ দিনের প্যাকেজে আপনি ঘুরে আসতে পারবেন দিল্লি, মুম্বাই, আগ্রা, জয়পুর, খাজুরাহো মন্দির, গোয়ালিওর, বারানসি, র্যানথাম্বোর, লক্ষ্ণ্যৌসহ আরো নানান শহর। বিলাসবহুল মহারাজা নিজেকে প্রমাণ করে আসছে, ২০১২-২০১৬ পর্যন্ত টানা লাক্সারি ট্রেন অব ওয়ার্ল্ড ট্রাভেল অ্যাওয়ার্ডে সরব উপস্থিতি সেই সাক্ষ্যই দেয়।
রোভোস
বিশ্বের সবচাইতে বিলাসবহুল ট্রেন কোনটি? “রোভোস।” ১৯৮৯ সালে রোহান ভোস নামক এক আফ্রিকানের হাত ধরে যার পথচলার সূত্রপাত। কি আছে এতে যা এটিকে অন্য সব ট্রেনের চেয়ে আলাদা করে তুলেছে? ট্রেনের কেবিন তিনটি। রয়্যাল স্যুট, ডিলাক্স স্যুট, পুলম্যান স্যুট। প্রথম শ্রেণীর এইসব স্যুট প্রায় ১৭০ স্কয়ার ফিট। এসবে রয়েছে একটি করে মাস্টার বেড, ড্রয়িং রুম, সোফা আর আপার ক্লাস বাথরুম। ট্রেনের কামরাগুলি তৈরি করা হয়েছে কাঠ দিয়ে। প্রতি কেবিনেই রয়েছে এয়ার কন্ডিশন, বার, বাথরুম। ট্রেনের সবচেয়ে বড় এবং লাক্সারিয়াস স্যুট হচ্ছে রয়েল স্যুট।
রোভোসের ভ্রমণ রুট হচ্ছে- দক্ষিণ আফ্রিকার প্রিটোরিয়া টু কেপটাউন পর্যন্ত। রয়েল স্যুটে বসে পথটুকু পাড়ি দিতে একজনকে গুণতে হবে বাংলাদেশি টাকায় ২ লাখের একটু বেশি। অবশ্য এরমধ্যে আপনার তিনবেলার খাবার, ড্রিঙ্ক আর ট্রেনে থাকা ডায়মন্ড মাইন মিউজিয়াম পরিদর্শনের ফি রয়েছে।রোভোসের যাত্রীদের জন্য রয়েছে সুনির্দিষ্ট ড্রেসকোড। রোভোসে রয়েছে ইন্টারনেট ব্যবহারের সুব্যবস্থা। একসঙ্গে ৭২ জন যাত্রী ভ্রমণ করতে পারে ট্রেনটিতে। রোভোসের অন্যতম আকর্ষণ হচ্ছে বিশেষভাবে তৈরিকৃত এর বড় বড় জানালা। যা দিয়ে বাইরের সৌন্দর্য্য আপনি উপভোগ করতে পারবেন, যেন নিজ বিছানায় বসে সাফারি পার্ক দেখছেন পর্দায়।
শিকি শিমা
রোভোস যদি হয় সবচাইতে বিলাসবহুল, সবচেয়ে আয়েশি তাহলে শিকি শিমা। নাম শুনেই আন্দাজ করতে পারছেন কিছুটা নিশ্চয়ই? জ্বি। এটি জাপানি ট্রেন। ২০১৭ সালের ১লা মে চালু হওয়া শিকি শিমার ভেতরে গেলে যে কেউ দ্বিধায় পড়বে! ইজ ইট ট্রেন অর ফাইভ স্টার হোটেল? ‘একটি মসৃণ ও মন ভালো করা যাত্রায় আশায় সুখময় এক ভ্রমণ’- এই স্লোগানকে সামনে রেখে চলা শিকি শিমা তার স্লোগানের কথা পালন করছে অক্ষরে অক্ষরে। ট্রেনটিতে বগির সংখ্যা দশটি। ঘন্টায় প্রায় ১১০ কিলোমিটার গতিতে ছুটতে পারা এই ট্রেন কোনরকম ঝাঁকুনি বা শব্দ ছাড়াই চলবে। শিকি শিমার বাথটাব, ফায়ার প্লেসের চমৎকার আরামদায়ক উষ্ণতা, প্রযুক্তির উৎকর্ষে চোখধাঁধাবার আগেই নেত্রযুগলে এক স্বপ্নময়তা ভেসে উঠবে।
যে রেললাইন ধরে ছুটছে ট্রেন তার দু’ধারে ফুলগাছ লাগানো। মেঝে থেকে ছাদ অবধি জানালার ওপাশটাকে মনে হবে হাত বাড়ালেই বুঝি ছুঁতে পারবেন! রাতের খাবার শেষে হাতে ড্রিংকস, আর আপনি হারিয়ে গেছেন পিয়ানোর সুরের মূর্ছনায়! ভাবা যায়? শিকি শিমায় যাত্রাটা প্যাকেজ হিসেবে। চারদিন তিনরাতের মনোরম যাত্রার প্রথম সবুজ সংকেত মিলবে টোকিও স্টেশান থেকে, জীবনের অন্যতম সেরা চারটি রাত উপহার দিয়ে জাপানের একদম উত্তর দিকের দ্বীপ হোক্কাইডোতে আপনাকে থামাবে এটি। শিকি শিমায় করে এহেন তৃপ্ততার স্বাদ আস্বাদন করতে আপনাকে বেশি গুণতে হবে না। সাড়ে আট হাজার মার্কিন ডলার কিম্বা বাংলা টাকায় সাত লাখের সামান্য বেশিতেই উপভোগ করে আসতে পারবেন সৌন্দর্য্যের পূর্ণ আলোকছটা। আর সঙ্গে সঙ্গী নিতে চাইলে টাকার অঙ্কটা দ্বিগুণ করলেই হবে!